নিজস্ব প্রতিবেদক : সারে ভর্তুকি চূড়ান্ত না করে সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ালে সংকট তৈরি হবে। কারখানাগুলো তীব্র আর্থিক সংকটে পড়বে। গ্যাস বিল পরিশোধে বিলম্বসহ সারের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিয়াম অডিটোরিয়ামে সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিতে গতকাল সোমবার বিসিআইসির পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়। তবে শুনানি শেষে কারও মতামত থাকলে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত লিখিত আকারে দেয়া যাবে বলে জানায় বিইআরসি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, গ্যাসের দাম প্রশ্নে সবদিক বিবেচনা করে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে। দাম বেড়ে গেলে সারের উৎপাদন খরচের বিষয়ে আপনারা চিন্তিত! অবশ্যই কৃষিকে বিবেচনায় নিতে হবে। জিডিপিতে কৃষির অবদান কম হলেও খাদ্যের নিরাপত্তা এবং বিশাল কর্মসংস্থানের বিষয়টি অবশ্যই ভাবনার রাখতে হবে। আবার এলএনজি আমদানির খরচের বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে।
এর আগে সকালে উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, গণশুনানি একটি আইনি প্রক্রিয়া, এর ন্যায্যতা প্রমাণের দায়িত্ব প্রস্তাবকারীর। আবার কেউ ভিন্ন প্রস্তাব করলে সেটির যৌক্তিকতা প্রমাণের দায়িত্ব ভিন্নমত পোষণকারীর। কমিশন যুক্তির যথার্থতা যাচাই করে আদেশ চূড়ান্ত করবে।
পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দাম বাড়ানো হলে বাড়তি ৭ কার্গো এলএনজি আমদানি করে সারে সরবরাহ করা হবে। ছয় মাস (অক্টোবর-মার্চ) পুরো মাত্রায় (২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস সরবরাহ দেয়া হবে। অবশিষ্ট ছয় মাসের মধ্যে এপ্রিল-মে ১৬৫ মিলিয়ন হারে, জুনে ১৭৫ মিলিয়ন এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৩০ মিলিয়ন হারে গ্যাস সরবরাহ দেবে। শনিবার সার উৎপাদনে ৯২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়েছে।
বিসিআইসির পরিচালক (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) দেলোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, ২০২২ সালে একইভাবে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে ৪ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যায়নি, বরং অনেকখানি কমেছে সরবরাহ। তবে যদি পুরোমাত্রায় গ্যাস দেয়া হয়, তাহলে ২০ লাখ টনের ওপরে সার উৎপাদন করা সম্ভব। আর ২০ লাখ টন সার উৎপাদন করা গেলে গ্যাসের ৩০ টাকা হলেও আমদানির তুলনায় কম দাম পড়বে। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম যদি ৩০ টাকা হয়, আর যদি ২০ লাখ টন উৎপাদন করতে পারি, তাহলে কেজি প্রতি সারের উৎপাদন খরচ পড়বে ৪৬ টাকার মতো। সেখানে আমদানিতে ৬১ টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে।
ট্রেড গ্যাপ (ভর্তুকি) সুরাহা না করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সার কারখানাগুলো তীব্র আর্থিক সংকটে পড়বে। গ্যাস বিল পরিশোধে বিলম্বসহ সারের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়তে পারে। গ্যাসের মিশ্রিত দর ২৮ টাকার নিচে হওয়ার উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিসিআইসি জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৩৮ টাকার মতো। বিসিআইসি ডিলারের কাছে ২৫ টাকা দরে বিক্রি করে। আর ডিলার বিক্রি করেন ২৭ টাকা দরে। ট্রেড গ্যাপ (উৎপাদন ও বিক্রয়মূল্যে ঘাটতি) ১৩ টাকা ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করছে সরকার। গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে সারের উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে। সেই ট্রেড গ্যাপের (ভর্তুকি) আগে সুরাহা হওয়া দরকার।
বিসিআইসি তার রিপোর্ট বলেছে, আগের সরবরাহ বাড়নোর কথা বলে গ্যাস দাম বাড়িয়ে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পিএলসি প্রায় পুরোমাত্রায় উৎপাদন করেছে। যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি গ্যাস অভাবে ৩৬১ দিন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি বন্ধ ছিল ২৭৩ দিন, ঘোড়াশাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি ১৯৮ দিন বন্ধ ছিল। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি মাত্র ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সময় উৎপাদনে ছিল। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আগের বছরের তুলনায় গ্যাস সরবরাহ কমেছে।
ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পিএলসির দৈনিক চাহিদা ৭২ মিলিয়ন ঘনফুট, শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট, চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের চাহিদা ৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট, যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আশুগঞ্জ সার কারখানা অনেক পুরোনো হওয়ায় গ্যাস খরচ অনেক বেশি, যে কারণে কারখানাটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
এছাড়া বিদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন কাফকো সার কারখানায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কাফকোকে চুক্তির আওতায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আর তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক দরে ডলারে সার কিনে নেয় বাংলাদেশ। সম্প্রতি কোম্পানিটির সঙ্গে ৩০ টাকা দরে চুক্তির নবায়ন করা হয়েছে।
বিসিআইসির দাবি, বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন ইউরিয়া সার জোগান দিতে হয়। গ্যাসের অভাবে আমদানি করে ১৬ থেকে ২১ লাখ টন জোগান দিতে হয়। গ্যাসের অভাবে বন্ধ থাকায় কারখানাগুলো কুলিং টাওয়ার, ইলেকট্রিক্যাল বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যার কারণে অপরেশনাল খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মনিরুজ্জামান বলেন, সারের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কোনও প্রস্তাবনা নেই। সে কারণে কৃষকের ওপর কোনো চাপ
পড়বে না। তবে সারের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই ঘাটতির পূরণের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়ার শুনানিতে বক্তব্য রাখেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) মিজানুর রহমান, পরিচালক (অপরেশন) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, জেনারেল ম্যানেজার মেহেরুল ইসলাম, তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ফজলে আলম, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স এসোসিয়েশনের নেতা রেজাবুদ্দৌলাসহ আরও অনেকে।

Discussion about this post